মা দিবস
১১ মে বিশ্ব মা দিবস। চলেন, আমি আপনাদের কাছে আমার মায়ের গল্প করি।
১৯৭১ সনের মার্চ মাসের শুরুর দিকের একটা দিন, সম্ভবত সাত তারিখের পরের ঘটনা এটা। আমি তখন নিতান্ত শিশু, বিস্তারিত স্মৃতি নাই, ভাসা ভাসা মনে আছে- আর খানিকটা স্মৃতি পুনর্গঠিত হয়েছে মায়ের কাছে শুনে, বই টই পড়ে, আর অন্য লোকের কাছে গল্প শুনে। যেমন, মার্চের তিন তারিখ বা সাত তারিখের গুরুত্ব তো আমি তখন বুঝিনি, পরে বুঝেছি, পরে বুঝে সেই সাথে ঘটনাবলী মিলিয়ে সম্ভাব্য তারিখটা অনুমান করছি।
আমরা তখন শ্রিবর্দীতে। আমাদের সাথে আমার বকুল আপা থাকতেন, তিনি আমার জ্যাঠাতো আপা, আমার মায়ের প্রায় সমবয়সীই, আমাদের বাসায় থেকে পড়াশুনা করতেন। একদিন দেখি আমাদের বাসায় যে সেলাই মেশিনটা ছিল, সেটাকে সিড়িঘরে পাতা হয়েছে, বকুল আপা সেখানে বসে এক গাদা কাটা কাপড় নিয়ে কিসব সেলাই করছেন। আমি ছিলাম আপার খুব ন্যাওটা, আমি গিয়ে আপার পাশে দাঁড়িয়েছি, কি সেলাই হচ্ছে। দেখি কি, আপা একটা করে কাতা কাপড়ের বান্ডেল নিচ্ছেন, একটা বড় সবুজ কাপড়ের মাঝখানে একটা লাল বৃত্ত জুড়ছেন, আর বৃত্তের মাঝখানে একটা সোনালী ম্যাপ।
শ্রীবর্দীতে একটা কলেজে হয়েছিল, সেই কলেজের একজন তরুণ টিচার, তিনি হাতে করে খবরের কাগজে মোড়ানো ঐসব কাটা কাপড়- সবুজ লাল আর হলুদ, মামনিকে দিয়ে গেছে। সেখানে অনেকগুলি ছোট বান্ডেল, একেকটা বান্ডেল ওরা খুলছে আর মামনি আর বকুল আপা মিলে একটার পর একটা জাতীয় পতাকা সেলাই করছে- নতুন দেশের নতুন পতাকা, সবুজের বুকে লাল আর লাল বৃত্তের মাঝখানে বাংলাদেশের মানচিত্র। আমি এখনো, এই যে আজকে দুই হাজার পঁচিশ সন হয়ে গেছে, আজও যখন আমার লাল সবুজ পতাকা উড়তে দেখি আকাশে, আমি আমার মায়ের মুখ দেখি আর বকুল আপার মুখ দেখি।
(২)
এর কিছুদিন পর একদিন সন্ধ্যায় একটা মশাল মিছিল হয়েছে- সেই মশাল মিছিলে আমার মা, আমার বকুল আপা ওরাও ছিলেন। শ্রীবর্দী আর কতোটুকু জায়গা, ঐখানেই পোস্ট অফিসের পাশে একটা জায়গা থেকে মশাল মিছিল শুরু, বড় রাস্তাটায় কিছুদূর গিয়ে আবার ফেরত আসা- এইই ছিল মশাল মিছিল। ছোটখাটো ও সংক্ষিপ্ত সেই মশাল মিশিলেই আমি সম্ভবত প্রথমবার জয়বাংলা শ্লোগান শুনেছিলাম। বকুল আপার করে আঙ্গুল ধরে এই অধম সেই মিহচিলে ছিল, নিতান্ত শিশুই ছিলাম তখন। সেই মশাল মিছিলটা থামিয়ে মাঝখানের একটা ফটোও তোলা হয়েছিল, বাজারের স্টুডিও থেকে একজন এসে ফটোটা তুলেছিল, আমার মায়ের মুখ ছিল সেই ফটোতে।
সেই যে পতাকাগুলি, সেইসব পতাকার একটা আমাদের বাসায় ছিল। পরে যখন শ্রীবর্দীতে পাকিস্তানী মিলিটারি আসে, আমার মা আর বকুল আপা মিলে সেই পতাকাটা একটা বড় বোতলে ভরে, ভতলের মুখটা মোম দিয়ে শীল করে পেছনের বাগানে দেয়ালের পাশে একটা পেঁপে পাছের পাশে মাটিতে পুতে রেখেছিলেন, ওদের আশা ছিল, দেশ স্বাধীন হলে সেই পতাকাটা বের করে ওড়াবেন। যুদ্ধের পর আমার মায়ের আর শ্রীবর্দীতে ফেরা হয়নি। আর যুদ্ধের সময়টা, সেই সময়টা আমরা ছিলাম নানাবাড়িতে, আমার মা আমাদের ভাইবোনদের সবাইকে নিয়ে পালিয়ে বেরিয়েছেন এই গ্রাম থেকে সেই গ্রাম।
যুদ্ধের সেই দিনগুলিতে আমার মা অনেক কষ্ট করেছেন, ভুগেছেন। না, পাকিস্তানীদের হাতে ধরা পড়েননি তিনি। তাঁর কষ্টের ধরণটা ভিন্ন ছিল সেই গল্প বলবো একদিন আপনাদের। বলতে কষ্ট হয়, এতো কাঁদতে ইচ্ছে করেনা সবসময়। তবু বলবো একদিন। আজ বরং একটা হাসির গল্প বলি।
(৩)
সেবার সিটি কর্পোরেশনের ইলেকশন হচ্ছে। তিনজন মুল প্রার্থী ছিলেন মোহাম্মদ হানিফ, মির্জা আব্বাস আর মঞ্জুরুল আহসান খান। আমরা ছয় ভাইবোন, আমরা সকলেই মামনিকে বারবার মনে করিয়ে দিই, মঞ্জুরুল আহসান খানকে ভোট দিতে হবে, চাকা মার্কা। যতবার আমরা মনে করিয়ে দিই, মামনিও আমাদের সাথে হ্যাঁ, হুম, আচ্ছা, এইসব বলেন। আমরা নিশ্চিত, মামনির ভোটটা কমিউনিস্ট পার্টিই পাবে। নির্বাচনী প্রচারণার মাঝখানেই একদিন আমার বোন নীলার বিয়ে, বিয়ের দাওয়াতে মঞ্জু ভাইও এসেছেন, মামনির কাছে ভোট দোয়া এইসব চেয়েছেন।
ভোটের দিন বাসাবো স্কুলের কেন্দ্রে ভোট দিতে গেছে মামনি, সাথে আমার বোনেরা। বুথে ঢুকার আগেও আমার বোনেরা মামনিকে মনে করিয়ে দিয়েছে, ‘মামনি, চাকা মার্কা, ভিল্বা না কিন্তু’। মামনিও হু হা বলে ঢুকে গেছে ভোট দিতে। ভোট কেন্দ্রের বাইরে আসার পর মামনিকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘মামনি, চাকা মার্কায় ভোট দিছ তো?’ মামনি উত্তর এড়াতে চিস্তা করেন কয়েকবার, পরে একটু রেগেই বলেছিলেন, সারাদিন ভোট দিলাম নৌকায়, এখন এসে তোদের কথায় চাকা ফাকা এইসব মার্কায় ভোট দিব?
এইটাই ছিলেন আমার মা। খুব বেশী পড়ালেখার সুযোগ পাননি, স্কুলে পড়ার সময় বিয়ে হয়ে গিয়েছিল আমার পিতার সাথে। ইংরেজি পড়তে পারতেন না, বাংলায়ই গল্প উপন্যাস পড়তেন। নিহাররঞ্জন, ফাল্গুনি, মাসুদ রানা, হুমায়ুন আহমেদ এবং হালের আনিসুল হক এইসব খুব পছন্দ করে পড়তেন। কাঁদতে খুব পছন্দ করতেন। পাড়া প্রতিবেশীর মৃত্যুতেও কাঁদতেন, অচেনা অজানা মানুষের বিয়ে বাড়ীতে গেলেও বিদায়ের সময় আমার মা কাঁদতেন- যেমন তেমন কান্না নয়, একদম হাপুস হুপুস করে কান্না। চা খেতে পছন্দ করতেন, বড় বড় কাপে চিনি দেওয়া চা। মাঝে মাঝে আওয়ামী লীগের মিটিং মিছিলেও যেতেন। এখন তো তিনি আর নেই আরকি।
(৪)
আজকে মাদারস’ ডে- বিশ্ব মা দিবস। আমি যখন অফিসে, তখন আমার সন্তানেরা ওদের মাকে নিয়ে বের হয়েছে। আমি আমার দিনের কাজ শেষ করতে করতে মায়ের কথা ভেবেছি। অবাক বিস্ময়ে খেয়াল করলাম, আমার কাছে আমার মা আর আমার দেশ মাঝে মাঝেই যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। মামনিই যেন আমার দেশ বা আমার দেশই যেন আমার দুঃখিনী মা।