সম্প্রতি সাভারে ঘটে যাওয়া মেয়ে কতৃক বাবাকে হত্যা প্রসঙ্গে আরিফ আজাদ তার ভেরিফাইড পেজে এই বক্তব্য তুলে ধরেছেন। আইডিয়াল টাইমসের পাঠকদেরে উদ্দেশ্যে তা হুবহু উপস্থাপন করা হলো।
(১)
সাভারের ভিডিওটা দেখে রীতিমতো বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছি। কী বিভৎস! কী পাশবিক!
একটা মেয়ে ঘরে থাকা ফল কাটার চাকু দিয়ে তার বাবাকে মেরে ফেলেছে নিজ হাতে। শুধু মেরেই ফেলেনি, পাশে বসে ভিডিও করেছে এবং ভিডিওতে তার রিহার্সালও প্রদর্শন করেছে। নিথর, নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে আছে বাবার মৃতদেহ, পাশে বসে মেয়েটা গোটা দুনিয়াকে দেখাচ্ছে তার বিভৎসতার স্বরূপ।
আইয়্যামে জাহেলিয়া তথা অন্ধকার যুগেও আপনি এমন একটা দৃশ্য কল্পনা করতে পারবেন? পরিপূর্ণ বয়সে পদার্পণ করা এক মেয়ের হাতে পিতার মৃত্যুর এমন করুণ, হৃদয়বিদারক একটা দৃশ্য?
ভিডিওতে মেয়েটা বলেছে—তার পিতা নাকি ধর্ষক ছিল, যার কারণে সে পিতাকে চরমতম শাস্তি দিয়েছে৷ ছুরি দিয়ে মৃতদেহের উপর লাগাতর আঘাত করতে থাকা একটা মেয়ের এই জবানবন্দি কতখানি সত্য আর কতখানি বিশ্বাসযোগ্য?
যা কিছু তথ্য বের হয়ে এলো তাতে দেখা যাচ্ছে—মূল কালপ্রিট নাকি সেই মেয়েটাই। সে মেয়ে, কিন্তু সে আদতে নাকি Somo Kami. তার এই কাজ বাবার চোখে পড়ে যায় এবং বাবা চেষ্টা করে মেয়েকে এই রাস্তা থেকে ফিরিয়ে আনতে। মেয়ে তো বাবার কথা শোনেই না, উল্টো বাবাকে থ্রেট করে। বান্ধবিদের সাথে নিজেদের বাসায় মেয়েটা দিনের পর দিন এসব কাজ করে যাচ্ছিল। নিরুপায় হয়ে, একদিন বাবা মেয়ের বান্ধবিদের বাসায় আসা বন্ধ করে দেয়। এতে ক্ষেপে যায় মেয়ে আর রীতিমতো ঘরের ফল কাটা ছুরি দিয়ে, ঘুমের ঘোরে আঘাতে আঘাতে মেরে ফেলে নিজের জন্মদাতা পিতাকে।
দু’চোখ বন্ধ করে একবার চিন্তা করুন—আমরা কোন জাহিলিয়াতের সময়ে ঢুকে পড়েছি!
(২)
এই ঘটনাটা আমাকে বারবার সুরা আল কাহফের সেই ঘটনাটার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল, যেখানে খিযির আলাইহিস সালাম একটা ছোট বাচ্চাকে মেরে ফেলেন। এতে আশ্চর্যান্বিত হয়ে পড়েন মুসা আলাইহিস সালাম। তিনি জিগ্যেস করে বসেন, ‘আপনি এই কাজ করলেন কেন?’
শেষে এসে জবাব দেন খিযির আলাইহিস সালাম। তিনি বলেন, ‘এই বাচ্চাটা বড় হয়ে তার বাবা-মার জন্য দুর্দশার কারণ হতো। তার বাবা-মা বিশ্বাসী এবং ভালো মানুষ। আমি আশা করি, তাদের রব তাদেরকে এই বালকের পরিবর্তে এমন সন্তানাদি দান করবেন যারা হবে উত্তম আর দয়াশীল’। ( সুরা আল কাহাফ, আয়াত ৮০-৮১ দ্রষ্টব্য)
সন্তানাদি বখে গিয়ে, আল্লাহর বিরুদ্ধাচারণ করে বাবা-মা’র জন্য দুর্দশার কারণ হয়ে উঠার চাইতে, সেই সন্তানাদির মৃত্যুকে শ্রেয় হিশেবে এই আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে।
শুধু একবার চিন্তা করুন, মেয়েটা যখন ছোট ছিল, তখন যদি তার বাবা আজকের দিনটার ব্যাপারে কোনোরকমে জানতে পারতেন, তিনি কি এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করতেন? তিনি কি সত্যিই এই মেয়েটাকে পেলেপুষে বড় করতেন?
(৩)
প্রিয় অভিভাবক, আপনারা যারা আমার এই লেখাটা পড়বেন, এই প্যারাটা একটু ভালোভাবে অনুধাবন করার অনুরোধ করছি।
দুনিয়া একটা ভিন্ন ডাইমেনশনে ঢুকে যাচ্ছে। এখনকার এক জেনারেশান অন্য জেনারেশানের চাইতে অত্যন্ত এডভান্স—জানার দিক থেকে যেমন, তেমনি অবাধ্যতা আর বিশৃঙ্খলার দিক থেকেও।
বিকেলে বাড়তি খেলাধুলো করে, বাবা-মা’র বকুনি আর কিলুনি থেকে বাঁচতে লুকিয়ে লুকিয়ে ঘরে ফেরার যে দিন আর যে জেনারেশান, সেই দিন আর সেই জেনারেশান বহু আগে গত হয়েছে। এখনকার বাচ্চাদেরকে বাবা-মায়েরাই ভয় পায়, বড়রা আতঙ্কে থাকে—ছোটরা কোন বিষয়কে কী মিন করে কী কাণ্ড ঘটায়৷ এখনকার বাচ্চাদের শাসন করা যায় না, চোখ রাঙানো যায় না, বাধ্য হওয়ার পাঠ দেওয়া যায় না।
কিন্তু, এভাবে একটা জেনারেশানকে শেইপ হতে দিলে, এই সমাজ, এই সভ্যতা একদিন এমনভাবে ভেঙেচুরে পড়বে যে—সাভারের এই ঘটনা আমাদের ঘরে ঘরে ঢুকে যাবে।
কীভাবে আমরা এই মহামারি থেকে নিজেরা বাঁচব আর পরিবারকে বাঁচাব, তাই তো?
সন্তান লালনপালনের যুগোপযোগি, যুগান্তকারী পথনির্দেশ ইসলামে বাতলানো আছে৷ সমস্যা হলো, আমাদের অধিকাংশের ধারণা—সন্তানকে ভালো আর দামি স্কুলে পড়ানো, তার যাবতীয় শখ, আহ্লাদ পূরণ করার নামই হয়ত সঠিক পিতামাতাসুলভ দায়িত্ব।
কস্মিনকালেও তা নয়।
প্যারেন্টিং একটা বড় জার্নির নাম। দীর্ঘ পরিশ্রম, সুদীর্ঘ সময় আর প্রচেষ্টার সম্মিলন একত্র হলেই একটা পরিবারে কার্যকর তারবিয়াহ বা প্যারেন্টিং নিশ্চিত করা যায়।
প্রিয় বাবা-মা, আপনাদের অনুরোধ করি, নিজের সন্তানাদির প্রতি সদয় হোন৷ আল্লাহর ওয়াস্তে তাদের প্রতি সেভাবে যত্নশীল হোন, যেভাবে যত্নশীল হতে পারলে সাভারের ঘটনার কোনো রেশ আপনার জীবনে তো দূর, আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাউকেই ভোগ করতে হবে না।
তার আগে দরকার আমাদের নিজেদের আমূল পরিবর্তন। আমরাই যদি পরিবর্তন হতে না পারি, কীভাবে আমরা আমাদের বাচ্চাদের মাঝে পরিবর্তনের আশা করতে পারি?
প্যারেন্টিং বা তারবিয়াহ সম্পর্কে একদমই ধারণা নেই? জানেন না কীভাবে বাচ্চাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নির্দেশিত পথে বড় করতে হবে?
সুবহানাল্লাহ! একটু সময় বের করুন প্রতিদিন। দুনিয়া এখন এত এত প্রসারিত যে—আপনি কিছু শিখতে চাইলে চারপাশে অঢেল রিসোর্স খুঁজে পাবেন। তারবিয়াহ বা উত্তম প্যারেন্টিং সম্পর্কে যেখানে যা পাবেন, গোগ্রাসে গিলতে থাকুন৷ স্বামী আর স্ত্রী দুজনে মিলে পড়ুন, দুজনে মিলে প্যারেন্টিং কোর্স করুন, বই পড়ুন, আর্টিকেল পড়ুন।
এই নিঃসীন অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে, আপনার একটু প্রচেষ্টা, হয়ত আপনার গোটা একটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচিয়ে দিবে, ইন শা আল্লাহ।
অনবরত অন্ধকারের দিকে ধেঁয়ে যাওয়া দুঃসহ দুনিয়ায়, সন্তানকে সঠিক মূল্যবোধ, সঠিক পরিচর্যা আর সঠিক দ্বীনের উপর কীভাবে বড় করতে হবে সে সম্পর্কে Sukun Publishing থেকে ‘আপনি যখন বাবা’ নামে একটি চমৎকার প্যারেন্টিংয়ের বই প্রকাশিত হয়েছে। বাবা-মা দুজনে একসাথে, দাগিয়ে দাগিয়ে পড়ার মতো একটা বই। সন্তানের সঠিক তারবিয়াহ নিয়ে যারা চিন্তিত, তারা এই বইটি দিয়ে শুরু করতে পারেন।
দুনিয়ার সমস্ত ফিতনা, জঞ্জাল আর অন্ধকার থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের পরিবারগুলোকে যেন রক্ষা করেন। আ-মীন।