সাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে টানা বৃষ্টিতে গোমতী পাড়ের মানুষের কপালে পড়ছে শঙ্কার ভাঁজ
আকাশে মেঘ ঘন হলেই মন খারাপ হয় গোমতী নদীর পাড়ের মানুষের। টানা বৃষ্টি হলেই জেঁকে বসে ভয়। কারণ কয়েকমাস আগেই অতিবৃষ্টিতে ভারতীয় পাহাড়ি ঢলে গোমতীর বাঁধ ভেঙে বন্যায় ভেসে গিয়েছিল শতাধিক গ্রাম।
সেই ধকল না কাটতেই এ বছর আবারও বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়েছে এই এলাকার মানুষ। সাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে টানা বৃষ্টিতে তাই কপালে পড়ছে শঙ্কার ভাঁজ।
বিভিন্ন মাধ্যমে আবহাওয়ায় পূর্বাভাসে ভারী বৃষ্টি ও নদীর পানি বৃদ্ধির যে কথা বলা হচ্ছে তা এখন কুমিল্লার নদী পাড়ের মানুষের কাছে ভয়ের বার্তা হয়ে উঠেছে।
বেশি ভয়ে থাকেন নদীর বেড়িবাঁধের ভেতরের বাসিন্দারা। তাদের ভয়, নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করলে আবার না হারাতে হয় বসত ভিটা, মাথা গোঁজার ঠাঁই।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ বলছে, আতঙ্কিত না হয়ে- সবাইকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়ে সচেতন হতে হবে।
কুমিল্লার সদর উপজেলার দুর্গাপুর এলাকার গোমতীর বেড়িবাঁধের ভেতরের বাসিন্দা জেলে প্রমোদ রঞ্জন বলেন, “গত তিন চারদিন আগে থেকেই ফেইসবুকে-খবরে শুনছি গোমতী নদীর পানি বাড়বে। এরপর থেকেই আকাশে মেঘ ধরলেই ভয় লাগে। আবার না গত বছরের মত হয়। টানা বৃষ্টি হলেই নদীর পানি বাড়বে- আর বাড়িঘর সব ডুববে।”
প্রমোদ বলেন, “গত বছর ভেবেছিলাম পানি অতটা উপরে উঠবে ন। কিন্তু মাঝরাতে হঠাৎ ঘরের ভিতরে পানি ঢুকতে শুরু করলো। বাচ্চাগুলারে নিয়া কোনো রকম পাড়ে উঠেছি। বাকি সব ডুবেছিল প্রায় ১৫ দিন। তাই এবার আগে থেকেই ভয় লাগছে।”
গত বছর অতিবৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢলে ১৮ আগস্ট থেকে হঠাৎ বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে গোমতী নদীর পানি। এরই মধ্যে ভারতে গোমতীর ডাম্বুলা বাঁধ খুলে দেয়ায় ২২ অগাস্ট রাতে কুমিল্লায় নদীর পানি বিপৎসীমার ১১৩ সেন্টিমিটার উপরে উঠে যায়।
নদীতে অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধির কারণে বুড়িচং উপজেলার বুড়িবুড়িয়া এলাকায় বাঁধ ভেঙে বানের পানিতে তলিয়ে যায় শতাধিক গ্রাম। ডুবে যায় বেড়িবাঁধের সব বাড়ি ঘর-কৃষিজমি। আগাম প্রস্তুতি না থাকায় সব ফেলে প্রাণ হাতে নিয়ে বাঁধের উপর আশ্রয় নেয় হাজারো মানুষ।
প্রায় দেড় হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ডুবে যায় কৃষি জমি, ভেসে যায় ফিশারি, গবাদি পশু-হাস মুরগির খামার। তিরিশ হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষয়ক্ষতির কথা জানায় সরকার।
সেই ভয় এখনো তাড়া করে বেড়ায় এই এলাকার মানুষজনকে। তাই এ বছর জেলায় যে কোনো প্রতিকূল আবহাওয়ার খবর আতঙ্ক সৃষ্টি করছে।
উপকূলীয় জেলা না হওয়ায় কুমিল্লার মানুষের আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানার অভ্যস্ততা নেই। কিন্তু গত বছরের দুর্ভোগের কারণে এবার বার বার খোঁজ নেওয়া হচ্ছে নদীর পানি বাড়লো কিনা, কতটুকু বাড়ছে, বিপৎসীমা ছাড়ানোর সম্ভাবনা আছে কিনা।
সদর উপজেলার পালপাড়া এলাকার গোমতী পাড়ের বাসিন্দা সত্তোরোর্ধ্ব বয়সী কৃষক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, “গতবার যে বন্যা হয়েছে এরকম আমার জীবনে দেখিনি। মানুষ যদি আগে জানতো তাহলে ঘরবাড়ি নিয়ে পাড়ে রাখতে পারতো।
তিনি বলেন, “সরকারের উচিত মানুষকে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়া। প্রয়োজনে মাইকিং করা। সঠিক তথ্য জানলে, বিপদ না থাকলে মানুষ অহেতুক আতঙ্কিত হবে না।”
একই এলাকার বাসিন্দা হালিমা খাতুন বলেন, “বন্যার পর এই বছর বাঁধ মেরামতের কাজ হচ্ছে। এটা দেখে কিছুটা হলেও সাহস পাই। আশা করি এই বছর আর বাঁধ ভাঙবে না।”
কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান বলেন, “এখন যে বৃষ্টিপাত হচ্ছে তাতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করার সম্ভাবনা নেই। আতঙ্ক না ছড়িয়ে আসলে আমাদের আবহাওয়া নিয়ে সচেতন হতে হবে। আমরা গোমতী নদীর বিষয়ে আপডেট রাখছি।”
কুমিল্লা আবহাওয়া অফিসের প্রধান আরিফুর রহমান বলেন, “কুমিল্লায় বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার এই তিনদিন ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা ছিল এবং বৃষ্টি হচ্ছে। বুধবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৪৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।”
কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) পঙ্কজ বড়ুয়া বলেন, “আমরা কুমিল্লা যে কোনো দুর্যোগ পরিস্থিতি নিয়ে প্রস্তুত আছি। খুব বেশি দুর্যোগপ্রবণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে কুমিল্লায় ৫৮৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত থাকে সব সময়।
“এছাড়া গোমতীর বুড়বুড়িয়া বাঁধ মেরামত কাজ শেষ। অন্যান্য জায়গায় বাঁধ সংস্কার কাজও চলমান রয়েছে। আশা করছি, কুমিল্লার মানুষ যে কোনো বৈরী পরিবেশে আগে থেকেই সতর্কতা পাবেন।”