মেয়েরা ইদানিং খুব সচেতন৷ পড়াশোনা করতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনে তারা নেমে যায় সেই ছোটবেলা থেকে। মাথার দুই পাশে দুই বেনী ঝুলিয়ে শিশু বয়স থেকেই তার পড়াশোনা জীবন শুরু। এরপর কৈশোর আসে, তারুণ্য আসে। তারুণ্য পেরিয়ে যৌবন এসে যায়। কিন্তু এখনও মেয়েটির পড়াশোনাটাই শেষ হয় না। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ, কলেজের পর ভার্সিটি, অনার্সটা শেষ হলে মাস্টার্স। এর শেষ কোথায়?
ক্যারিয়ার জীবন যদি পড়াশোনার লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে এই ক্যারিয়ারকে গড়ার পিছে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে প্রায় দেড় যুগেরও বেশি সময়! নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে, মনোযোগ ও অধ্যবসায়ের সাথে!
স্কুল জীবন হওয়ার কথা ১০ বছর, তবে এখনকার সময়ে প্লে, নার্সারি, কেজি যোগ করলে দাঁড়ায়, ধরলাম, সে প্লে পড়ে নাই, তবু সময়টা দাঁড়াচ্ছে এরকম–
স্কুল = ১২ বছর
কলেজ = ২ বছর
অনার্স = ন্যূনতম ৪ বছর
সেশন জট, ফেইল, রাজনৈতিক বা পারিপার্শ্বিক কারণে ঘটা বিরতি চিন্তা করলে, ভার্সিটি পর্যন্ত একটা মেয়ের শিক্ষাজীবনের সময়সীমা দাঁড়াচ্ছে প্রায় – ১৮ বছর!
দীর্ঘ ১৮ বছরের শ্রম দেয়ার পর, একজন মেয়ে তার সাবজেক্ট অনুযায়ী কোনো জব পাবে কিনা নিশ্চয়তা নেই।
শুধুমাত্র ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার বা এই ধরনের পড়াশোনার মাধ্যমে হয়ত ক্যারিয়ার মোটামুটি নিশ্চিত করা যেতো, যদিও সেসব ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রেও অনেক রকম সমস্যা বা বাধাবিপত্তি আছে। তাছাড়া সব মেয়েই তো ইঞ্জিনিয়ারিং বা ডাক্তারি পড়ে না।
আমি এমন অনেক মেয়েকে চিনি, যারা ভালো বা সরকারি ভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে, বাধ্য হয়ে এমন কিছু ‘অকাজের’ সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করেছে, যেটার কোনো ভবিষ্যত নেই। যেমন – সংস্কৃত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইসলামিক ইতিহাস, বাংলা ইত্যাদি। সে নিজেও জানে, এসব সাবজেক্টে পড়ে ভালো কোথাও জব হবে না, তবুও একটা ডিগ্রি বা সার্টিফিকেটের আশায় পড়া চালিয়ে যায়। কারণ তা নাহলে সে সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না।
অর্থাৎ এত কষ্ট করে পড়াশোনার পর, জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ১৮টা বছর ইনভেস্ট করার পরেও একটা মেয়ে তার ক্যারিয়ারকে নিশ্চিত করছে পারল না।
এখন তার জন্য অপশন তিনটি–
১. এদের মধ্যে কেউ কেউ চাকরি খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে যাবে। কিন্তু কোনো জবই পাবে না। কারণ বলাই বাহুল্য, চাকরির বাজার খুবই প্রতিযোগিতামূলক। এখানে ডিমান্ডের চেয়ে সাপ্লাই বেশি। প্রতি বছর হাজারো ছাত্রছাত্রী গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করছে, কিন্তু সেই তুলনায় হাজার হাজার জব ফিল্ড নেই।
২. আবার কেউ কেউ চাকরি পাবে, কিন্তু তার যে সাবজেক্টে পড়েছে, সেই সেক্টরে কোনো জব পাবে না, কারণ হয়তো আমাদের দেশে সেই সেক্টরে তেমন কোনো কাজের ক্ষেত্র তৈরিই হয় নি। কিংবা হলেও সেগুলো খুব সীমিত এবং বেশি লোকের ডিমান্ড নেই। ফলে তাকে এমন কোনো চাকরিতে ঢুকতে হবে, যেগুলোর সাথে তার পড়াশোনার সাবজেক্টের কোনো মিলই নেই। যেমন – বোটানি পড়ার পর ব্যাংকে চাকরি নেয়া। অনেকে বাস্তবতার সামনে বাধ্য হয়ে এমন সব জায়গায় জব করবে, যেগুলো সমাজে অতটা প্রশংসনীয় নজরে দেখা হয় না, যেমন – প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। কিংবা অফিসে ভালো পরিবেশ নেই, জেনেও জয়েন করবে। অল্প কিছু হাতে গোণা মেয়েরা প্রতিযোগিতায় টিকে ভালো চাকরির সন্ধান পাবে, যেমন – বেসরকারি জব, যেখানে আর্নিং ভালো এবং কাজ ভালো করলে প্রমোশনের চান্স আছে।
৩. আরও পড়াশোনা করা বা উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন। যেহেতু চাকরি বাজারে তেমন সুবিধা করা যাচ্ছে না, তাই অনেকেই এই অপশনটা বেছে নিবে। কেউ বিসিএস করবে, কেউ মাস্টার্স। কেউ কেউ হায়ার এডুকেশনের জন্য বাইরের দেশে চলে যাবে।
অর্থাৎ দেখুন, ১৮ বছর পড়াশোনার পরেও অপশন কতটা লিমিটেড। আপনি যদি একেবারে টপ ক্লাস ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার না হতে পারেন, বা খুব ভালো রেজাল্ট করে স্কলারশিপে বিদেশে পড়াশোনা করতে না পারেন, তাহলে বাংলাদেশে বসে আপনাকে ভালো একটা ক্যারিয়ারের আশায় আবারও পড়াশোনা করতে হবে। নতুবা, মোটামুটি গোছের চাকরি নিয়েই খুশি থাকতে হবে। আর ওয়ার্স্ট কেইসে কোনো চাকরিই জুটবে না।
ওদিকে অনার্স শেষ করতে করতে মেয়ের বয়স মোটামুটি ২২ থেকে ২৫ এর মধ্যে চলে এসেছে। পরিবার থেকে বিয়ের জন্য চাপাচাপি করছে। মেয়ে নিজেও হয়তো কাউকে পছন্দ করে ফেলেছে।
আমার চেনা বেশিরভাগ আত্মীয়-স্বজন, কাজিন, পরিচিত যারা এই বয়সী, তাদের একটা না, বেশ কয়েকটা প্রেম এই বয়সের মধ্যে হয়ে যায়। ইভেন অনেকে শারীরিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
এরপরেও পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার চিন্তায় একটা মেয়ে এতটাই আচ্ছন্ন থাকে যে, সে বিয়ের চিন্তা মাথায় আনতে পারে না।
সে ভয় পায়, বিয়ে করলে সাংসারিক চাপ, পারিবারিক ব্যস্ততা, সন্তান ধারণের সম্ভাবনা আছে। যার কারণে তার পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পরিচিত, বন্ধু-বান্ধবী বা আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে এমন অনেক মেয়ে আছে, যারা রিলেশনশিপে থাকা সত্ত্বেও ছেলেটাকে এই মুহূর্তে বিয়ে করতে রাজি না। ২২-২৫ এ বিয়ে তাদের কাছে প্রেসার মনে হয়। মুরুব্বিরা যদি বিয়ে করবা কবে জিজ্ঞেস করে, তারা প্রচণ্ড বিরক্ত হয়।
কেউ কেউ যদিও বা বিয়ে করে ফেলে, তবুও সে পরবর্তী ধাপের পড়াশোনা (যেমন – মাস্টার্স, বিসিএস ইত্যাদি) কিংবা সদ্য পাওয়া চাকরিটা নিশ্চিত রাখতে সহজে বাচ্চা নিতে চায় না। বাচ্চাকে সে ক্যারিয়ার ও পড়াশোনার পথে ‘বাধা’ হিসেবে বিবেচনা করে। সে ভাবে, এখন বাচ্চা নিলে আমি আর জীবনটা নিয়ে কিছুই করতে পারব না। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারব না। সমাজে আমার অবস্থান তৈরি করতে পারব না।
যারা বিয়ে করে, তাদের মধ্যে কেউ সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়লে যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। পরিচিত অনেক আপুকে দেখেছি যারা বিয়ের পর একেবারে নিয়ম মেনে জন্মনিরোধক পিল ব্যবহার করতো, কিন্তু তারপরেও কেউ কেউ প্রেগনেন্ট হয়ে পড়েন। প্রথম প্রেগনেন্সি জানার খবরটা নারীদের জীবনে খুবই রোমাঞ্চকর এবং সুখকর একটা অনুভূতি, অথচ এই আপুদেরকে দেখেছি তারা লিটরেলি কান্না করেছে। বাচ্চা পেটে আসলো কেন ভেবে ভয়, হতাশা, আফসোস তাদেরকে গ্রাস করতো। কেউ কেউ বাচ্চা নষ্ট পর্যন্ত করে ফেলে, কারণ এত দ্রুত বাচ্চা নিতে চায় না। আর যারা কোনোক্রমে বাচ্চা নেয়, তারা বাচ্চার পিছে সময় দিতে চায় না। তাদের জীবনে ক্যারিয়ার আর পড়াশোনার গুরুত্ব অনেক বেশি। কেননা সেই ছোটবেলা থেকে সে ক্যারিয়ার এবং পড়াশোনার পিছে বছরের পর বছর ধরে সময়, শ্রম এবং মেধা ইনভেস্ট করেছে, এই পড়াশোনার পিছে তার পরিবার ঢেলেছে লাখ লাখ টাকা, এবং সে নিজেও এত বছর ধরে ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক স্বপ্ন বুনেছে। এই স্বপ্ন নিজ হাতে তো ধ্বসিয়ে দেয়া যায় না। তাই বিয়ে করে, একটা সুন্দর সংসার পেয়ে, সন্তান লাভ করেও মেয়েদের ভালো লাগে না। পূর্ণতা আসে না। বরং তার কাছে এগুলোকে বাধা মনে হয়। সে এগুলোকে পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারের পথে প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত করে।
একটা মেয়ের জীবনে সবচেয়ে সুন্দর সময়– তার তারুণ্য, তার যৌবন সে পুরোপুরি ডেডিকেট করছে পড়াশোনা তথা ক্যারিয়ার গড়ার পিছে। ২২-২৫ বছরে বিয়ের পিড়িতেই বসছে না বেশিরভাগ শহুরে নারী। অথচ রিসার্চার এবং ডাক্তারদের মতে, বিশের কোঠায় মেয়েদের ফার্টিলিটি রেইট সবচেয়ে ভালো থাকে। এরপর প্রজননক্ষমতা আস্তে আস্তে কমতে থাকে। এবং কমতে কমতে এক পর্যায়ে মেয়েটি সন্তান ধারণে অক্ষম হয়ে পড়ে। চল্লিশ বা পয়তাল্লিশে অনেকের মেনোপজ হয়ে যায়।
চিন্তা করে দেখুন, ২২-২৫ বছর বয়সে এখন ঠিক কয়টা মেয়ে বাচ্চা নেয়? আর যারা নেয়, তাদেরকে সমাজ কী নজরে দেখে?
পড়াশোনার জন্য ইনভেস্ট করতে গিয়ে মেয়েরা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবনে, ইমোশনাল ওয়েল বিইং এ ইনভেস্ট করতে ভুলে যায়। হয়ত প্রথম দিকে তার বিয়ে-সংসার-বাচ্চাকাচ্চাকে বাধা মনে হয়, কিন্তু যতই দিন যায়, ততই সে আবিষ্কার করে– শুধু পড়াশোনা বা ক্যারিয়ারই একটা মানুষের জীবনে ‘সব’ না। তখন তার একটা সংসার পেতে থিতু হতে ইচ্ছে করে। মা ডাক শুনতে মন চায়। অথচ ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
বিশেষ করে এই যুগে, নারীদের থাইরয়েড, পিসিওএস, ফাইব্রয়েড ইত্যাদি শারীরিক রোগের হার অনেক বেশি। তাই সে দেরিতে বিয়ে করে দেরিতে বাচ্চা নিতে গিয়ে দেখা যায়, আর গর্ভধারণ করতেই পারে না। তিরিশের শেষে বা চল্লিশের কোঠায় এসে আফসোস করতে থাকে।
এখন হয়তো আমরা এই আফসোসের গল্পগুলো খেয়াল করছি না, কিন্তু অতি শীঘ্রই এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করবে। আমরা এমন অসংখ্য দম্পতি খুঁজে পাব, যারা সন্তান লাভে ব্যর্থ। এমন অনেক নারী চিনব, যাদের অধিক বয়সের জন্য সন্তান গ্রহণ ঝুঁকিপূর্ণ।এমন অজস্র নারী দেখব, যারা এই জীবনে আর কখনোই মা হতে পারবে না।
অবশ্যই সবাই নিঃসন্তান হবে না। অনেকেই তিরিশের পরে, এমনকি চল্লিশে এসেও মা হতে পারে। কিন্তু যারা মা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তাদের বেশিরভাগ মাত্র একজন সন্তান গ্রহণ করতে ইচ্ছুক। কেউ কেউ একাধিক সন্তান নেয়ার ইচ্ছা রাখা সত্ত্বেও গর্ভধারণে জটিলতা এবং শারীরিক অসুস্থতার কারণে আর সন্তান নিতে পারে না। ফলে একটা প্রজন্ম গড়ে উঠছে যারা ভীষণ রকমের নিঃসঙ্গ, বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান, কোনো ভাইবোন নেই।
এই একটামাত্র সন্তানকেও নারীরা সময় দিতে অপারগ। কারণ একই সাথে তাকে ক্যারিয়ারের দিকটাও সামলে চলতে হয়। ফুলটাইম ৯টা-৫টা কাজের পরে সন্তানের দিকে পূর্ণ মনোযোগ দেয়া কঠিন না, প্রায় অসম্ভব। মানুষ যেহেতু রোবট না, তারও কিছু বিশ্রাম দরকার। কর্মক্ষেত্রে চাপ, যাতায়াতে ক্লান্তি, যানজট ইত্যাদি ঠেলে সে যখন বাড়িতে পৌঁছে দেখে তাকে রান্না করতে হবে কিংবা সন্তানের দেখভাল করতে হবে, তার কাছে বিষয়টা যথেষ্ট বিরক্তিকর, ক্লান্তির এবং জটিল মনে হয়। সাংসারিক কাজ বোঝার মতো লাগে। সন্তানকে দেখাশোনা করতে বিরক্ত লাগে।
সন্তান দেখাশোনার ভার কমাতে, তাকে পাঠানো হয় চাইল্ড কেয়ারে কিংবা রেখে যাওয়া হয় বুয়ার কাছে। এসব বাইরের লোকের কাছে অনেক বাচ্চা চাইল্ড অ্যাবিউজের শিকার হয়। এই ট্রমা বাচ্চারা সারাজীবন কাটিয়ে উঠতে পারে না। মায়ের ক্যারিয়ারের কাছে সন্তানের মানসিক চাহিদাগুলো উপেক্ষিত হতে থাকে৷ কিছু কিছু পরিবারে দাদী-নানী এখনও বেঁচে আছে, ফলে মেয়েরা বাইরে কাজে যাওয়ার সময় নানী-দাদীরা বাচ্চাকে দেখাশোনা করে। কিন্তু এই সুবিধা খুব বেশিদিন থাকবে না। এখনকার যেসব মেয়ে ক্যারিয়ারে ফোকাস করতে গিয়ে বাচ্চাদেরকে মা কিংবা শাশুড়ির কাছে রেখে যাচ্ছে, তাদের মা বা শাশুড়ির কম বয়সে বিয়ে হয়েছিল। ফলে ৫০-৬০ বছর বয়সেও তারা নাতিনাতনিকে দেখাশোনা করতে সক্ষম। কিন্তু নতুন প্রজন্ম যদি এ যুগের মেয়েদের মতোই দেরিতে বিয়ে এবং দেরিতে সন্তান নেয়, তাহলে বেশিরভাগই এ যুগের মেয়েদের কাছে নানী-দাদী সার্ভিস পাবে না।
বাংলাদেশের নারীদের গড় আয়ু ৭৩ বছর।
এর মধ্যে ২৫-৩০ বছর কেটে যাচ্ছে পড়াশোনায়,
এরপর ক্যারিয়ার ২৫-৩০ থেকে শুরু মাত্র।
বিয়ের প্রতি অনীহা, অনাগ্রহ, ক্যারিয়ার নষ্টের ভয় – ফলে বিয়ে পেছাতে পেছাতে ২৮-৩০, বা আরো দেরিতে।
বিয়ে হওয়ার পর বাচ্চাকে বোঝা মনে করা, দেরিতে বাচ্চা নেয়ার প্রবণতা। ফলে প্রথম সন্তান নেয়ার এইজটা দাঁড়ায় – ৩২/৩৫/এমনকি ৪০।
এদিকে, বাংলাদেশী নারীদের গড়ে ৪৬-৪৭ বছরেই মেনোপজ হয়ে যায়।
দ্বিতীয় বাচ্চা নেয়ার ইচ্ছা বা অপশন থাকে না, তৃতীয়/চতুর্থ সন্তান ভাবাই যায় না।
অর্থাৎ এই সিস্টেমে পড়াশোনা করার ফলে, ক্যারিয়ারকে প্রাধান্য দিয়ে চলার মাধ্যমে মেয়েদের গর্ভধারণের উইন্ডোটা হয়ে যাচ্ছে খুবই সংকীর্ণ। মাত্র কয়েকটা বছর। এর মধ্যে সে সন্তানধারণে যদি সক্ষম হয়েও যায়, সন্তানকে বড় করার জন্য ঠিক কয়টা বছর তার হাতে থাকবে? ঠিক কতগুলো বছর সে সন্তানের পাশে থাকতে পারবে?
শেষ বয়সে মানুষ নিজেরাই দুর্বল হয়ে পড়ে। সন্তানকে দেখাশোনা করতে পারেনা, বরং নিজেদেরই সেসময় যত্নের প্রয়োজন।
যদি ধরে নিই, সে গড় আয়ুর হিসাবে ৭৩ বছর বাঁচবে, তবুও সন্তানকে মাত্র বিশের কোঠায় রেখেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে। না সে দেখতে পাবে এ সন্তানের সাফল্য, না সন্তানের বিয়ে, নাতি-নাতনির মুখ দেখা তো অনেক পরের কথা! এবং সন্তানদের বেশিরভাগই একমাত্র সন্তান হওয়াতে বাবা-মা মারা যাবার পরে, আপন আত্মীয়-স্বজন ছাড়া ভয়ংকর একাকী ও ডিপ্রেসড জীবন কাটাবে। আমরা কি এমন জীবনই চাই?
উপরের প্রতিটা পরিণতির জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দায়ী দীর্ঘমেয়াদি পড়াশোনা এবং ক্যারিয়ারের প্রতি অতিরিক্ত ফোকাস। পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারে বেশি মাত্রায় ঝুঁকে যাওয়ার কারণে, ব্যক্তিজীবনে সঠিক চয়েস করতে ব্যর্থ হয় নারীরা। সন্তান গ্রহণ কিংনা সন্তানের দেখাশোনার পিছে দেয়ার মতো সময় ও শক্তি অবশিষ্ট থাকে না। এভাবে চলতে থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমরা এক বিভীষিকাময় পৃথিবী রেখে যাব, যেখানে ছেলেমেয়েদের ক্যারিয়ার হয়ত থাকবে, কিন্তু তাদের জীবন থেকে মা-বাবার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে অনেক দ্রুত।
পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারের উদ্দেশ্য হলো — সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, ভালো থাকা, ভালো উপার্জন করা। আমরা যদি মাত্র বিশ-পচিশ বছরের সন্তানকে একা ফেলে মারা যাই, তাহলে আমাদের আয়/উপার্জন দিয়ে কী লাভ হবে? জীবনে মা-বাবা-ভাইবোনের অস্তিত্ব থাকবে না যার, যে টাকা দিয়ে কী করবে?
আমরা নারীরা, যখন শিক্ষা ও কর্মজীবন নিয়ে অতিরিক্ত সচেতন হয়ে পড়ি, তখন নিজের অজান্তেই আত্মঘাতী কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই। বিয়ে-সংসার-সন্তানকে বোঝা মনে করার মানসিকতা থেকে আমরা স্বার্থপর হয়ে উঠি। নিজেরা ৪০ বছর বয়সে এসেও মায়ের সাপোর্ট পাচ্ছি, আমাদের বাচ্চারা পাচ্ছে মামা-খালা, চাচা-ফুপুর আদর। অথচ আমাদের সন্তানরা বিশেই মাথার উপর থেকে বাবা-মায়ের ছাদ হারাবে। আমাদের নাতি-নাতনিরা জানবে না নানুর আদর, দাদীর ভালোবাসা কী জিনিস। আপন মামা-চাচাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে একটা গোটা প্রজন্মে!
পড়াশোনা অবশ্যই জরুরি। নিজের একটা পরিচয় তৈরির ইচ্ছা থাকাটাও দোষের নয়। কিন্তু আমরা যখন শিক্ষা ও কর্মজীবনে প্রতিটি ধাপেই এগিয়ে থাকার জন্য মরিয়া হয়ে যাই, আর পারিবারিক জীবনের প্রতিটি ধাপেই গড়িমসি আর বিলম্ব করতে থাকি, তখন পরিণতি হয় বিধ্বংসী।
দেরিতে বিয়ে, দেরিতে বাচ্চা, বাচ্চা হলেও একটার বেশি নয় — এসব সূত্র নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করে আমরা আমাদের সন্তান এবং পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করছি। সময় থাকতে নিজেদের অবস্থানকে যাচাই করতে শিখুন। স্রোতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে ওয়াইজ ডিসিশন নিন। সংসারকে হ্যাঁ বলুন। সন্তান গ্রহণকে হ্যাঁ বলুন। পড়াশোনা বা ক্যারিয়ারের জন্য নিজেকে, নিজের সন্তান-সন্ততিকে, নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মকে বঞ্চিত করবেন না। পড়াশোনার জন্য জীবন না, জীবনের জন্যই পড়াশোনা। সেই পড়াশোনাকে নিশ্চিত করতে যখন জীবনটাই এলোমেলো হয়ে যায় তারচেয়ে বড় উপহাস পৃথিবীতে আর একটিও নেই।
শিরোনাম:
পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার, কি পাচ্ছি কি হারাচ্ছি? আনিকা তুবা
-
আইডিয়াল টাইমস
- Update Time : ১২:৫০:০০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫
- ৩২ Time View
See less
Tag :
নারী
Popular Post
Last Update