Dhaka ০৫:২৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ০২ জুন ২০২৫, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইসমাইল (আ.)-এর আত্মত্যাগ

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৫:৫৪:১৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩১ মে ২০২৫
  • ৬ Time View

ইসমাইল (আ.)-এর আত্মত্যাগ: কোরবানির প্রকৃত অর্থ
ইসলামি ইতিহাসে কোরবানির সূচনা এক মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে। ইসমাইল (আ.)-এর ধৈর্য, ইবরাহিম (আ.)-এর আনুগত্য—সব মিলিয়ে কোরবানি শুধুমাত্র পশু জবাইয়ের অনুষ্ঠান নয়, বরং আত্মসমর্পণ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সর্বোচ্চ প্রয়াস।
ইবরাহিম (আ.)-এর প্রার্থনা ও ইসমাইল (আ.)-এর জন্ম
ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছিলেন:

“হে প্রভু! আমাকে একটি নেককার সন্তান দান করুন। ফলে আমি তাকে একটি ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম।” (সুরা সাফফাত : ১০০)

জীবনের শেষপ্রান্তে আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা কবুল করেন এবং তাঁকে সন্তান দান করেন। নবজাতকের নাম রাখেন ইসমাইল—যার অর্থ, ‘আল্লাহ শোনেন’। আরবি ‘ইসমা’ অর্থ ‘শোনা’ এবং হিব্রু ভাষায় ‘ইল’ অর্থ ‘আল্লাহ’। এই নামের মধ্যেই নিহিত রয়েছে ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়ার কবুল হওয়ার তাৎপর্য।

শৈশবেই পরীক্ষা
ইসমাইল (আ.)-এর জন্মের পরপরই তিনি কঠিন পরীক্ষায় পড়েন। আল্লাহর নির্দেশে ইবরাহিম (আ.) স্ত্রী হাজেরা ও শিশুপুত্রকে জনমানবহীন মরুভূমিতে, বর্তমান কাবাগৃহ সংলগ্ন স্থানে ফারান পাহাড়ের পাদদেশে রেখে আসেন। তখন পানির জন্য মা হাজেরা (আ.)-এর সাফা ও মারওয়ার মধ্যে দৌড়াদৌড়ির ইতিহাস আজও হজের অংশ হয়ে আছে। সেই দৌড়ের পুরস্কারস্বরূপ ইসমাইলের পায়ের নিচে থেকে ঝরতে থাকে পানির ঝরনা—আজকের ঝমঝম কূপ।

স্বপ্নে নির্দেশ, বাস্তবে আত্মসমর্পণ
ইসমাইল (আ.) যখন কৈশোরে পদার্পণ করেন, তখন ইবরাহিম (আ.) এক রাতে স্বপ্নে দেখেন, তিনি পুত্রকে জবাই করছেন। পয়গম্বরদের স্বপ্ন ওহি হিসেবে গণ্য হয়, তাই এটি ছিল আল্লাহর নির্দেশ।

ইবরাহিম (আ.) কোনো প্রশ্ন না করে তা পালনের সংকল্প করেন। পুত্রকে ডেকে বলেন, “হে বৎস! আমি স্বপ্নে তোমাকে জবাই করতে দেখেছি। এতে তোমার কী মত?”
ইসমাইল (আ.) বিনয়ের সঙ্গে জবাব দেন:

“আব্বাজান! আপনাকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা পালন করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।” (সুরা সাফফাত : ১০২)
এই উত্তরে ভবিষ্যৎ নবীসুলভ আদব, আল্লাহর ওপর ভরসা এবং পিতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ পায়।

মিনায় আত্মত্যাগের দৃশ্য
ইবরাহিম (আ.) ইসমাইলকে নিয়ে মিনার পথে রওনা হন। পথে শয়তান বাধা সৃষ্টি করতে চেষ্টা করে, কিন্তু ইবরাহিম (আ.) তাঁকে তিনবার পাথর নিক্ষেপ করে তাড়িয়ে দেন—যার স্মৃতিতে হাজীরা আজও মিনায় শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করেন।

মিনায় ইসমাইল (আ.) নিজেই বলেন, যেন পিতা তাঁর মুখ না দেখেন এবং চোখ বাঁধেন, যাতে আবেগে সিদ্ধান্তে ভাটা না পড়ে। যখন ইবরাহিম (আ.) ছুরি চালাতে যান, আল্লাহ তা থামিয়ে দেন এবং পরিবর্তে পাঠান একটি মহান জন্তু।

“তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে। আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি… আমি তার পরিবর্তে দিলাম এক মহান জন্তু।” (সুরা সাফফাত : ১০৩-১০৭)

আত্মত্যাগের শিক্ষা
ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর কোরবানির ঘটনাটি আমাদের শেখায়—আল্লাহর নির্দেশের সামনে সব কিছু উৎসর্গ করা ঈমানের পরিপূর্ণতা। কোরবানি শুধুই পশু জবাই নয়; এটি আমাদের অহং, লোভ ও জাগতিক মোহ কোরবানি দেওয়ার শিক্ষা।

ইসমাইল (আ.)-এর ইন্তেকাল
ইসমাইল (আ.) ১৩৬ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। কিছু সূত্রে বলা হয়, তিনি ফিলিস্তিনে ইন্তেকাল করেন, আবার অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, তিনি মক্কায় কাবাঘরের পাশে সমাহিত হয়েছেন।

উপসংহার
আজকের কোরবানি সেই ঐতিহাসিক আত্মত্যাগের স্মরণে। আল্লাহর নির্দেশে নিঃস্বার্থ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) আমাদের শিখিয়ে গেছেন কিভাবে প্রকৃত তাকওয়া অর্জন করতে হয়। এই কোরবানি যেন আমাদের অন্তরকেও শুদ্ধ করে—এই হোক আমাদের প্রার্থনা।

বিষয়: কোরবানি | ধর্ম ও জীবন | ইসলামি ইতিহাস
লেখক: [আবুবকর বিন রাশেদ]

Tag :
About Author Information

ইসমাইল (আ.)-এর আত্মত্যাগ

Update Time : ০৫:৫৪:১৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩১ মে ২০২৫

ইসমাইল (আ.)-এর আত্মত্যাগ: কোরবানির প্রকৃত অর্থ
ইসলামি ইতিহাসে কোরবানির সূচনা এক মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে। ইসমাইল (আ.)-এর ধৈর্য, ইবরাহিম (আ.)-এর আনুগত্য—সব মিলিয়ে কোরবানি শুধুমাত্র পশু জবাইয়ের অনুষ্ঠান নয়, বরং আত্মসমর্পণ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সর্বোচ্চ প্রয়াস।
ইবরাহিম (আ.)-এর প্রার্থনা ও ইসমাইল (আ.)-এর জন্ম
ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছিলেন:

“হে প্রভু! আমাকে একটি নেককার সন্তান দান করুন। ফলে আমি তাকে একটি ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম।” (সুরা সাফফাত : ১০০)

জীবনের শেষপ্রান্তে আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা কবুল করেন এবং তাঁকে সন্তান দান করেন। নবজাতকের নাম রাখেন ইসমাইল—যার অর্থ, ‘আল্লাহ শোনেন’। আরবি ‘ইসমা’ অর্থ ‘শোনা’ এবং হিব্রু ভাষায় ‘ইল’ অর্থ ‘আল্লাহ’। এই নামের মধ্যেই নিহিত রয়েছে ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়ার কবুল হওয়ার তাৎপর্য।

শৈশবেই পরীক্ষা
ইসমাইল (আ.)-এর জন্মের পরপরই তিনি কঠিন পরীক্ষায় পড়েন। আল্লাহর নির্দেশে ইবরাহিম (আ.) স্ত্রী হাজেরা ও শিশুপুত্রকে জনমানবহীন মরুভূমিতে, বর্তমান কাবাগৃহ সংলগ্ন স্থানে ফারান পাহাড়ের পাদদেশে রেখে আসেন। তখন পানির জন্য মা হাজেরা (আ.)-এর সাফা ও মারওয়ার মধ্যে দৌড়াদৌড়ির ইতিহাস আজও হজের অংশ হয়ে আছে। সেই দৌড়ের পুরস্কারস্বরূপ ইসমাইলের পায়ের নিচে থেকে ঝরতে থাকে পানির ঝরনা—আজকের ঝমঝম কূপ।

স্বপ্নে নির্দেশ, বাস্তবে আত্মসমর্পণ
ইসমাইল (আ.) যখন কৈশোরে পদার্পণ করেন, তখন ইবরাহিম (আ.) এক রাতে স্বপ্নে দেখেন, তিনি পুত্রকে জবাই করছেন। পয়গম্বরদের স্বপ্ন ওহি হিসেবে গণ্য হয়, তাই এটি ছিল আল্লাহর নির্দেশ।

ইবরাহিম (আ.) কোনো প্রশ্ন না করে তা পালনের সংকল্প করেন। পুত্রকে ডেকে বলেন, “হে বৎস! আমি স্বপ্নে তোমাকে জবাই করতে দেখেছি। এতে তোমার কী মত?”
ইসমাইল (আ.) বিনয়ের সঙ্গে জবাব দেন:

“আব্বাজান! আপনাকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা পালন করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।” (সুরা সাফফাত : ১০২)
এই উত্তরে ভবিষ্যৎ নবীসুলভ আদব, আল্লাহর ওপর ভরসা এবং পিতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ পায়।

মিনায় আত্মত্যাগের দৃশ্য
ইবরাহিম (আ.) ইসমাইলকে নিয়ে মিনার পথে রওনা হন। পথে শয়তান বাধা সৃষ্টি করতে চেষ্টা করে, কিন্তু ইবরাহিম (আ.) তাঁকে তিনবার পাথর নিক্ষেপ করে তাড়িয়ে দেন—যার স্মৃতিতে হাজীরা আজও মিনায় শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করেন।

মিনায় ইসমাইল (আ.) নিজেই বলেন, যেন পিতা তাঁর মুখ না দেখেন এবং চোখ বাঁধেন, যাতে আবেগে সিদ্ধান্তে ভাটা না পড়ে। যখন ইবরাহিম (আ.) ছুরি চালাতে যান, আল্লাহ তা থামিয়ে দেন এবং পরিবর্তে পাঠান একটি মহান জন্তু।

“তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে। আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি… আমি তার পরিবর্তে দিলাম এক মহান জন্তু।” (সুরা সাফফাত : ১০৩-১০৭)

আত্মত্যাগের শিক্ষা
ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর কোরবানির ঘটনাটি আমাদের শেখায়—আল্লাহর নির্দেশের সামনে সব কিছু উৎসর্গ করা ঈমানের পরিপূর্ণতা। কোরবানি শুধুই পশু জবাই নয়; এটি আমাদের অহং, লোভ ও জাগতিক মোহ কোরবানি দেওয়ার শিক্ষা।

ইসমাইল (আ.)-এর ইন্তেকাল
ইসমাইল (আ.) ১৩৬ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। কিছু সূত্রে বলা হয়, তিনি ফিলিস্তিনে ইন্তেকাল করেন, আবার অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, তিনি মক্কায় কাবাঘরের পাশে সমাহিত হয়েছেন।

উপসংহার
আজকের কোরবানি সেই ঐতিহাসিক আত্মত্যাগের স্মরণে। আল্লাহর নির্দেশে নিঃস্বার্থ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) আমাদের শিখিয়ে গেছেন কিভাবে প্রকৃত তাকওয়া অর্জন করতে হয়। এই কোরবানি যেন আমাদের অন্তরকেও শুদ্ধ করে—এই হোক আমাদের প্রার্থনা।

বিষয়: কোরবানি | ধর্ম ও জীবন | ইসলামি ইতিহাস
লেখক: [আবুবকর বিন রাশেদ]